বরেন্দ্র নিউজ ডেস্ক:
গল্পটা মধ্যবিত্তের। ভালো নেই তারা। টানাটানি। দীর্ঘশ্বাস। জীবন নামের গাড়ির চাকা যেন চলেই না। এমনিতে সারা দুনিয়াতেই মধ্যবিত্ত সংকটে। বাংলাদেশে অবস্থা আরো শোচনীয়। শেয়ার থেকে চাকরির বাজার কোথাও তাদের জন্য সুখবর নেই।
পাবলিক লাইব্রেরি অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে চোখ ফেললেই আপনি বুঝতে পারবেন, একটি চাকরির জন্য কেমন লড়াই চলছে। দীর্ঘ দিন ধরে পতনের বৃত্তে বন্দি শেয়ারবাজার। যেখানে বিনিয়োগের একটি বড় অংশ মধ্যবিত্তদের। উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। এরও সবচেয়ে বড় শিকার মধ্যবিত্ত। নাজুক মধ্যবিত্তের জন্য বাড়তি সংকট হিসেবে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্য। পিয়াজ যে সে কবে সেঞ্চুরি মেরেছিল তার আর পতন হয়নি। উল্টো চাউল, রসুন আর আদার দামও বাড়ছে দফায় দফায়।
সর্বশেষ ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সুদের হার আগের তুলনায় অর্ধেক করা হয়েছে। সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের অনেক কষ্টের জমানো অর্থ, পেনশনের অর্থ ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখতেন। মধ্যবিত্ত যাবে কোথায়- এই প্রশ্ন যখন বড় হচ্ছে তখন অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। যদিও এরই মধ্যে হতাশ হয়ে অনেকেই ডাকঘর থেকে জমা দেয়া অর্থ সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবছেন। সঞ্চয়ের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্তকে একেবারেই অযৌক্তিক মনে করেন বাংলাদেশ ইন্সটিউিট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সরকার ব্যাংকের আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ ও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়নের জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংক বিনিয়োগ অবশ্যই বাড়াতে হবে, তবে সেটা নিম্ন আয়ের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। এ অল্প পরিমাণ সঞ্চয়ে সুদ কমিয়ে ব্যাংকে বিনিয়োগ বাড়ানো অসম্ভব ব্যাপার।
উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মানবজমিনকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে যখন টানাপড়েন চলে তার প্রথম শিকার হয় মধ্যবিত্ত। এরমধ্যে দুই ভাগ লোক হয়তো দেখা যায় মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হয়ে যায়। কিন্তু ১০ ভাগ লোক মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত হয়ে যায়। আমাদের অর্থনীতি কে কীভাবে চালায় তা পরিষ্কার নয়। বিনিয়োগ নেই, চাকরি নেই। চাকরি হচ্ছে মধ্যবিত্তের টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন। যে কারণে মধ্যবিত্তের বড় অংশ হতাশায় ভুগছে। মধ্যবিত্ত সবসময় নিরাপত্তা খোঁজে। সে যে স্বল্প পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করে তা ব্যাংকে জমা রেখে মুনাফা চায়। কিন্তু এখন ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত বড়ধরনের সংকটের মুখে।’
দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিআইডিএস’র এক গবেষণা অনুযায়ী মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার। এতে দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। এই অবস্থায় চাকরি যেন এখন রীতিমতো সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। বিসিএস বা কোনো সরকারি চাকরি হলেতো কথাই নেই। কয়েকটি পদের বিপরীতে কয়েক হাজার দরখাস্ত পড়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। প্রায় প্রতি ছুটির দিনেই চাকরি পরীক্ষায় লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। বছর কয়েক আগে বিআইডিএস’র এক জরিপে বলা হয়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৪৮.৪ ভাগ বেসরকারি চাকরি করে। সরকারি চাকরি করে ২০ শতাংশ, ২২ শতাংশ ব্যবসা করেন। দেশে গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরিতে সুযোগ সুবিধা যেভাবে বেড়েছে বেসরকারি চাকরিতে তেমনটা ঘটেনি। এতেও মূলত বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশে একদিকে উন্নয়ন হচ্ছে অন্যদিকে বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। গত বছর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ধনী-গরিবের বৈষম্যে তৈরি হয়েছে রেকর্ড।
এতে দেখা যায়, বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এই তালিকায় বাংলাদেশের সামনে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারত ছিল। বাকি তিনটি দেশ ছিল আফ্রিকার নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া। ঢাকার এক অর্থনীতিবিদের মতে, বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৯৫ ভাগ চলে যাচ্ছে ৫ ভাগ মানুষের হাতে। বছর বছর তারা আরো ধনী হচ্ছেন। বাকি ৯৫ ভাগ মানুষ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মতিঝিলে গেলেই মানুষের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। শেয়ারবাজার যে কত মধ্যবিত্তকে রাস্তায় বসিয়েছে তার হিসাব রাখা দায়। দিনকে দিন তারা পুঁজি হারিয়েছেন। অসহায় চোখে চেয়ে দেখা ছাড়া যেন কিছুই করার ছিলো না তাদের। সরকার অবশ্য নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই ইতিবাচক ফল মেলেনি।
মধ্যবিত্তদের জন্য সময়টা ভালো যাচ্ছে না। যদিও সমাজ ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য মধ্যবিত্তদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নানামুখী চাপে কাহিল বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত কতদিন টিকে থাকে- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সুত্র: মানবজমিন
Leave a Reply